ধর্মীয় বিভাজন নয় - ড. একে এম শামছুল ইসলাম

ধর্মীয় বিভাজন নয়

বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ হোক সর্বভৌমত্ব ও জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি

ড. একে এম শামছুল ইসলাম

বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তাঁর শাসনামলে সর্বাধিক যে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বাস্তবায়ন করেছিলেন সেটি হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, সংহতি, ঐক্য এবং ভ্রাতৃত্বের ভিত্তি সুদৃঢ়করণ। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে ধর্মীয় ভ্রাতৃত্ব ও সংহতির ভিত্তিকে মজবুত করার জন্য তিনি মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলামের মতো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন।

বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী জিয়া কখনো ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি কেবল ধর্মীয় কারণে কারো প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ পছন্দ করতেন না। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ছিল তাঁর একমাত্র আদর্শ। তাঁর কাছে কোনো ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী বা শ্রেণী বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল না।

সম্প্রতি ভাসানী অনুসারী পরিষদ বলেছে, বিএনপিকে ধর্মীয় মৌলবাদী দল না হয়ে ধর্মনিরপেক্ষ দলের মতো আচরণ করতে হবে। অথচ বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়, ধর্মীয় বিভাজনকে অতিক্রম করার মধ্য দিয়ে। তারা আবার বলছে, বিএনপির সাথে যদি জামায়াতের জোট না হয়, তবে বিএনপি বিপুলভাবে বিজয়ী হবে। অর্থাৎ তারা ধরে নিচ্ছে জামায়াত হলো বিএনপির জন্য একটি বড় বোঝা।

তবে আমি মনে করি ভাসানী অনুসারী পরিষদ বিএনপিকে সাহায্য করতে চায়। তারা মনে করছে বিএনপি জামায়াতকে পাশে রাখলে ভোট হারাবে। এটা তাদের সুপারিশ হতে পারে, তবে বাধ্যবাধকতা নয়। বিএনপি তার নিজের রাজনৈতিক কৌশল অনুযায়ী নির্বাচন করবে।

জামায়াতকে যদি বিএনপি সত্যিকার অর্থে পাশে রাখে, তবে বিএনপি বিপদে পড়বে না। বিএনপি হলো জনগণের দল, জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসে। বিএনপি জামায়াতকে নিয়ে যতটা লাভবান হয়, তারচেয়ে বেশি হয়তো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে রাজনীতির দিক থেকে বিষয়টি নেতিবাচক নয়।

বর্তমানে জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী দলগুলোর মধ্যে বিএনপি একমাত্র দল, যারা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা থেকে নিজেকে দূরে রেখেছে। বিএনপি শুরু থেকেই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হলো মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, ঐক্য, সংহতি ও সর্বভৌমত্ব। জিয়া এই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে স্বাধীন বাংলাদেশকে গড়ে তুলেছিলেন।

বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে কোনো আপস করেনি। এ কারণে বিএনপি আজও জনগণের হৃদয়ে স্থান করে নিতে পেরেছে।

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে বিএনপির পাশাপাশি আর কোনো দলকে দৃঢ় অবস্থানে দেখা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি দাবি করলেও তারা মূলত ভারতীয় আধিপত্যবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। আওয়ামী লীগ তার জাতীয়তাবাদকে বিসর্জন দিয়েছে।

জিয়াউর রহমান যখন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন, তখন তার মূল লক্ষ্য ছিল একটি স্বাধীন, সার্বভৌম, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন রাষ্ট্র নির্মাণ। তিনি চেয়েছিলেন বাংলাদেশে সব ধর্মের মানুষ যাতে সমানভাবে বাঁচতে পারে।

বর্তমান সময়ে আমরা সেই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকেই খুঁজছি। এ জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেই হতে পারে জাতীয় ঐক্য। বাংলাদেশের জনগণ আজ ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করছে। জনগণ চায় মুক্তি। জনগণ চায় স্বাধীনতা। জনগণ চায় গণতন্ত্র। জনগণ চায় একটি কল্যাণ রাষ্ট্র।

আমাদের জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি যদি হয় বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, তবে সেটিই হবে সঠিক পথ। এই জাতীয়তাবাদেই আছে স্বাধীনতা, সর্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র ও উন্নয়নের নিশ্চয়তা। আওয়ামী লীগের মতো ভারতমুখী জাতীয়তাবাদ নয়, বিএনপি চায় বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের ভিত্তিতে একটি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করতে।

আজ বাংলাদেশের জনগণের সামনে দুটি পথ—
প্রথমত, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ভারতকেন্দ্রিক রাজনীতি;
দ্বিতীয়ত, বিএনপির নেতৃত্বে বাংলাদেশকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদ।

জনগণ ঠিক করবে কোন পথ তারা বেছে নেবে। আমি মনে করি জনগণ কখনো ভারতকেন্দ্রিক রাজনীতি মেনে নেবে না। জনগণ বাংলাদেশকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদকেই বেছে নেবে। এটাই হবে ভবিষ্যৎ রাজনীতির মূল ভিত্তি।

লেখক। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, পিএসসি, জি (অব)
সাবেক সেনা কর্মকর্য ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।