দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া: আপসহীন নেতৃত্বের অবিচল প্রতীক
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আপসহীন নেতৃত্বের অনন্য প্রতীক হিসেবে যে নামটি সর্বজন স্বীকৃত, তিনি হলেন— বেগম খালেদা জিয়া। একদিকে তিনি বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী। অন্যদিকে নিজের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, ত্যাগ, সাহস ও আপসহীন অবস্থানের মাধ্যমে তিনি এদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দুতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবন বারবার প্রমাণ করেছে যে তিনি ক্ষমতার জন্য নয় বরং নীতির প্রশ্নে আপসহীন থেকেছেন, স্বৈরাচারের কাছে মাথা নতো করেননি। গণতন্ত্রের পক্ষে জনতার কণ্ঠস্বর হয়েছেন এবং বারবার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যের ঝুঁকি নিয়ে জনগণের অধিকার রক্ষার সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। তাঁর জীবন শুরু হয়েছিল সাধারণ এক পারিবারিক পরিবেশে।
রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম না নিলেও ইতিহাসের এক চরম প্রয়োজনীয় মুহূর্তে তিনি বাংলাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যখন মেজর জিয়াউর রহমান পাকিস্তানি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, তখন বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন সেনানিবাসে অন্তরীণ। দুই শিশু সন্তানসহ অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে কাটিয়েছেন তাঁর বন্দিজীবন। পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে ও তাঁর সন্তানদের বন্দী করে রেখেছিল এবং এই সময়ে তিনি যে মানসিক দুর্ভোগ সহ্য করেছেন, সেটি তাঁকে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক জীবনে দৃঢ়তা দিয়েছে ও আপসহীন এক নেতৃত্ব তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
স্বাধীনতার পর তিনি রাজনৈতিক মঞ্চে সক্রিয় ছিলেন না বরং শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্রপতিত্বকালে নীরবে পারিবারিক দায়িত্ব পালন করে গেছেন। কিন্তু ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে একদল বিপথগামী সেনা কর্মকর্তার হাতে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শাহাদতবরণ করলে তাঁর জীবনে নেমে আসে এক মহাবিপর্যয়। স্বামী হারানোর ব্যক্তিগত শোকের মধ্যেও তিনি দ্রুত বুঝতে পারেন যে, শহীদ জিয়া’র রেখে যাওয়া রাজনৈতিক দল বিএনপিকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো সাহসী, জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব প্রয়োজন। সেই কঠিন দায়িত্ব সময়ের প্রয়োজনে মাথা পেতে নেন তিনি।
১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি, যখন দেশ স্বৈরাচার এরশাদ শাসনের অধীনে তখন বেগম খালেদা জিয়া সক্রিয়ভাবে রাজপথে নামেন। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি’র চেয়ারপার্সন হিসেবে তিনি— ছাত্র, যুব, মহিলা, শ্রমিকসহ সর্বস্তরের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেন। একাধিকবার গৃহবন্দি ও কারাবন্দি হওয়া সত্ত্বেও তিনি আন্দোলন চালিয়ে যান। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তাঁর আপসহীন অবস্থান ছিল এমন যে, ক্ষমতার প্রলোভন বা ব্যক্তিগত সুবিধা দিয়ে তাঁকে দ্বিধান্বিত করা সম্ভব হয়নি।
১৯৯০ সালে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়া’র নেতৃত্বে বিএনপি বিজয়ী হয় এবং তিনি গণতান্ত্রিকভাবে বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচিত নারী প্রধানমন্ত্রী হন। এসময় তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, নারীর ক্ষমতায়ন, মুক্তবাজার অর্থনৈতিক সংস্কার এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে না থাকলেও তিনি বিরোধী দলের নেতা হিসেবে সংসদ ও রাজপথে সমানতালে লড়াই চালিয়ে যান।
বিপুল জনসমর্থনে ২০০১ সালে বেগম খালেদা জিয়া পুনরায় ক্ষমতায় এসে জঙ্গিবাদ দমন, সড়ক অবকাঠামো উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী করতে পদক্ষেপ নেন। তবে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ এবং বিরোধী দলের ষড়যন্ত্রের কারণে তাঁর শাসনামল নানামুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে পড়ে। তবু রাজনীতিতে তাঁর নৈতিক অবস্থান ও আপসহীন চরিত্রের কারণে দলীয় নেতাকর্মীদের কাছে তিনি পরিণত হন এক অনুপ্রেরণার প্রতীকে।
২০০৭ সালের ১/১১ সামরিক-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বেগম খালেদা জিয়া’র জীবনের আরেকটি কঠিন অধ্যায় শুরু হয়। দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। দুই পুত্রসহ দীর্ঘদিন কারাগারে রাখা হয় এবং তাঁকে ও তাঁর সন্তানদেরকে যেতে হয় চরম শারীরিক ও মানসিক ভোগান্তির ভেতর দিয়ে। এই সময় ক্ষমতার লোভে বা ব্যক্তিগত মুক্তির বিনিময়ে তিনি কোনো রাজনৈতিক আপসে রাজি হননি। এটাই তাঁর আপসহীন চরিত্রের অন্যতম বড় প্রমাণ। পরবর্তী বছরগুলোতে রাজনৈতিক প্রতিশোধমূলক মামলায় তিনি বারবার গ্রেপ্তার, গৃহবন্দি ও বিদেশগমনের ওপর নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হন। স্বাস্থ্য পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটলেও তিনি নিজের অবস্থান থেকে সরে আসেননি। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সমঝোতার পথে না গিয়ে তিনি লড়াইয়ের পথ বেছে নেন। এর ফলে তিনি জনগণের কাছে ‘আপসহীন দেশনেত্রী’ হিসেবে স্থায়ী স্বীকৃতি পান।
বেগম খালেদা জিয়া’র নেতৃত্ব কেবল রাজনীতির মাঠেই সীমাবদ্ধ ছিল না; দুর্যোগ মোকাবিলা, গণমানুষের দুঃখ-কষ্ট ভাগ করে নেওয়া এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা– সব ক্ষেত্রেই তিনি অদম্য ছিলেন। তাঁর এই দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে একটি সাধারণ সূত্র রয়েছে– নীতির প্রশ্নে আপসহীনতা। বেগম খালেদা জিয়া’র রাজনৈতিক জীবন একদিকে যেমন অনুপ্রেরণার প্রতীক। অন্যদিকে তা হলো— এক অবিরাম সংগ্রামের ইতিহাস। তাঁর আপসহীনতার প্রকৃত চিত্র স্পষ্ট হয় তখনই, যখন আমরা দেখি ক্ষমতার শীর্ষে থেকেও তিনি নিরংকুশ ও একচেটিয়া ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন হননি। ১৯৯১ সালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরই তিনি সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার যে ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেন; সেটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এক নতুন যুগের সূচনা করে। এই পরিবর্তন তাঁকে নির্বাহী ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিকারী থাকার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছিল এবং তিনি স্বেচ্ছায় সেই ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দেন। কারণ তাঁর বিশ্বাস ছিল— গণতন্ত্রে যিনি মনে করতেন, ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’।
এই সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নীতি, বিশেষ করে বাজারমুখী অর্থনৈতিক সংস্কার এবং বেসরকারি খাতকে শক্তিশালী করার পদক্ষেপগুলো ছিল দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের পরিকল্পনা থেকে নেওয়া। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ, রপ্তানি বৃদ্ধি এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে তিনি দেশের অর্থনীতিতে নতুন গতি দেন। তাঁর শাসনামলে গার্মেন্টস শিল্প ব্যাপক প্রসার লাভ করে, যা আজকের বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল— তিনি যে কোনো নীতি বা সিদ্ধান্ত গ্রহণে জনগণের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছেন; যদিও সেসময় কিছু পদক্ষেপ রাজনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।
২০০১ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে বেগম খালেদা জিয়া কঠোর হাতে জঙ্গিবাদ দমন করেন, যা আন্তর্জাতিক মহলেও প্রশংসিত হয়। এই সময়ে তিনি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উন্নতি, যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং আঞ্চলিক কূটনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) শীর্ষ সম্মেলন সফলভাবে আয়োজন তাঁর কূটনৈতিক সক্ষমতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তবে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় আসে ২০০৭ সালের ১/১১-এর ঘটনায়। সামরিক-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুর্নীতির অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার করে এবং মাসের পর মাস কারাগারে বন্দি রাখে। শারীরিক অসুস্থতা, পারিবারিক কষ্ট এবং রাজনৈতিক চাপ— সবকিছুর মাঝেও তিনি নীতিগত অবস্থান থেকে সরেননি। অনেকেই তখন ব্যক্তিগত মুক্তির বিনিময়ে রাজনৈতিক আপস করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া সেই পথ বেছে নেননি। বরং তিনি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি’র ঐক্য অটুট রাখতে, জনগণের আস্থা ধরে রাখতে এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে বেগবান রাখতে নিজেকে কষ্টের পথে ঠেলে দেন।
২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে বিএনপি’র অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তও তাঁর আপসহীন নেতৃত্বের প্রতিফলন। ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ন্যূনতম স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার নিশ্চয়তা না পেয়ে তিনি নির্বাচন বর্জন করেন; যদিও এটি রাজনৈতিকভাবে বড় ঝুঁকি ছিল। তাঁর কাছে নীতি ও ন্যায়বিচার ব্যক্তিগত বা দলীয় স্বার্থের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
এরপরের সময়ে বেগম খালেদা জিয়া নানাবিধ মামলা, গ্রেপ্তার ও কারাবাসের শিকার হন। ২০১৮ সালে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের মিথ্যা ও সাজানো মামলায় সাজা দিয়ে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়, যেখানে তাঁর স্বাস্থ্যের মারাত্মক অবনতি হয়। বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি বিদেশ যেতে না পারা এবং উন্নত চিকিৎসা না পাওয়ায় অসহনীয় কষ্ট সহ্য করেছেন। সরকার বিভিন্ন সময়ে শর্তসাপেক্ষে মুক্তির প্রস্তাব দিলেও তিনি তাতে সম্মত হননি। কারণ সেই শর্তগুলো তাঁর রাজনৈতিক ও নৈতিক অবস্থানকে ক্ষুণ্ণ ও প্রশ্নবিদ্ধ করত।
আজকের দিনে— বেগম খালেদা জিয়া কেবল একটি রাজনৈতিক দলের নেত্রী নন; তিনি গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের এক অবিচল প্রতীক। তিনি দেখিয়েছেন, আপসহীনতা মানে শুধু বিরোধিতা নয়, বরং নীতির প্রতি অবিচল থেকে জনগণের পাশে দাঁড়ানো। বেগম খালেদা জিয়া’র এই অবস্থান তাঁকে সমর্থকদের কাছে যেমন অবিস্মরণীয় মর্যাদা দিয়েছে; তেমনি বিরোধীদের কাছেও একজন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও অদম্য নেতা হিসেবে স্বীকৃত হয়েছেন। তাঁর এই দীর্ঘ রাজনৈতিক যাত্রা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট। বেগম খালেদা জিয়া আপসহীন দেশনেত্রী হিসেবে সর্বজন স্বীকৃতি পেয়েছেন; কারণ তিনি প্রতিটি সংকটে নীতি, ন্যায়বিচার ও জনগণের স্বার্থকে ব্যক্তিগত বা দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন। ইতিহাসে তাঁর অবস্থান সেইসব নেতার কাতারে যারা ক্ষমতার জন্য নয় বরং জনগণ ও দেশের জন্য রাজনীতি করেছেন।
বেগম খালেদা জিয়া’র নেতৃত্ব শুধু বাংলাদেশের ভেতরে সীমাবদ্ধ ছিল না; আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও তিনি ছিলেন এক গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর। তাঁর কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী ছিল সুস্পষ্ট— বাংলাদেশের স্বার্থকে সর্বাগ্রে রাখা এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গণে দেশের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখা। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি— যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ভারত, জাপান, সৌদি আরবসহ বিশ্বের বিভিন্ন শক্তিধর দেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করেন। বিশেষ করে আঞ্চলিক কূটনীতিতে তাঁর অবদান ছিল অনস্বীকার্য— দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক)-এর কার্যক্রম সক্রিয় করতে তিনি যে ভূমিকা পালন করেন তা বাংলাদেশের আঞ্চলিক গুরুত্ব বাড়িয়ে দেয়।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাঁর নেতৃত্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল—বাংলাদেশকে কোনো প্রকার প্রভাব বলয়ে টেনে নেওয়ার সুযোগ না দেওয়া। তিনি বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক ভারসাম্যপূর্ণ নীতি অনুসরণ করতেন যাতে দেশের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সহযোগিতা আদায় করা যায়। তাঁর শাসনামলে আন্তর্জাতিক সাহায্য ও উন্নয়ন সহযোগিতা যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছিল যা অবকাঠামো উন্নয়ন ও সামাজিক খাতে ব্যয় করা হয়। তবে আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাঁর দৃঢ় অবস্থান কেবল কূটনৈতিক ক্ষেত্রে নয়; মানবাধিকার, নারী নেতৃত্ব এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষার ক্ষেত্রেও ছিল সুস্পষ্ট। পশ্চিমা বিশ্বের অনেক গণমাধ্যম তাঁকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী নারী নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসে ইন্দিরা গান্ধী, শ্রীমাভো বন্দরনায়েকে এবং আউং সান সু চির মতো নামের পাশে বেগম খালেদা জিয়ার নামও উচ্চারিত হয়, তবে বেগম জিয়ার ক্ষেত্রে আপসহীনতার বৈশিষ্ট্য তাঁকে আলাদা মাত্রা দিয়েছে।
রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের দিক থেকে বেগম খালেদা জিয়া এক বিশাল রাজনৈতিক কাঠামো রেখে যাচ্ছেন। বিএনপি তাঁর নেতৃত্বে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত সংগঠিত হয়েছে এবং তাঁর নীতিগত অবস্থান নতুন প্রজন্মের রাজনীতিকদের জন্য এক শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত বলে বিবেচিত। তাঁর রাজনৈতিক উত্তরাধিকার শুধু দলীয় সংগঠনে সীমাবদ্ধ নয় বরং গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, এবং ন্যায়বিচারের সংগ্রামে যে নজির তিনি স্থাপন করেছেন সেটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গভীরভাবে প্রোথিত থাকবে। তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল সাধারণ মানুষের সাথে গভীর সংযোগ। দুর্যোগে মানুষের পাশে দাঁড়ানো, কৃষক, শ্রমিক, নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা শোনা— যা তাঁকে ‘জনগণের নেত্রী’তে পরিণত করেছে। ক্ষমতায় থাকাকালীন যেমন, তেমনি ক্ষমতার বাইরে থেকেও তিনি জনতার আস্থা হারাননি।
বেগম খালেদা জিয়া’র আপসহীনতা সবচেয়ে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে সেই মুহূর্তগুলোতে; যখন ব্যক্তিগত জীবন, স্বাস্থ্য, স্বাধীনতা সবকিছুই হুমকির মুখে থাকা সত্ত্বেও তিনি নীতি থেকে বিচ্যুত হননি। রাজনৈতিক বন্দিত্ব, স্বাস্থ্য সংকট, পারিবারিক শোক— কোনো কিছুই তাঁকে পথ পরিবর্তনে প্রলুব্ধ করতে পারেনি। ক্ষমতাসীনদের সাথে গোপন সমঝোতা বা রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার পথ তিনি বেছে নেননি। কারণ তাঁর কাছে নীতি ও গণমানুষের স্বার্থই ছিল সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।
বাংলাদেশের ইতিহাসে আপসহীন নেতার সংখ্যা হাতে গোনা। মওলানা ভাসানী তাঁর নীতির জন্য, শহীদ জিয়াউর রহমান তাঁর জাতীয়তাবাদের জন্য এবং বেগম খালেদা জিয়া তাঁর গণতন্ত্র রক্ষার জন্য চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তিনি প্রমাণ করেছেন, রাজনীতি শুধু ক্ষমতার খেলা নয়; রাজনীতি হতে পারে নীতির প্রশ্নে আত্মত্যাগের ক্ষেত্রও।
আজ যখন বেগম খালেদা জিয়া বার্ধক্য ও অসুস্থতার সঙ্গে লড়ছেন, তখনও তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান সুদৃঢ়। অনেকেই মনে করেন— তিনি যদি রাজনৈতিক আপস করতেন; তবে হয়তো আজ স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতেন। কিন্তু তখন তিনি বেগম খালেদা জিয়া হতেন না— হতেন আর দশজন সুবিধাবাদী রাজনীতিকের মতো একজন। তাঁর আপসহীনতা তাঁকে ইতিহাসে স্থায়ী আসন দিয়েছে।
উপসংহারে বলা যায়— দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া শুধু বিএনপি’র নেতা নন, তিনি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এক অনন্য প্রতীক। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দুই শিশু সন্তানসহ বন্দিজীবন, স্বামী হত্যার শোক, স্বৈরাচার বিরোধী গণআন্দোলন, তিনবার প্রধানমন্ত্রিত্ব এবং অসংখ্যবার কারাবাস— সবকিছু মিলিয়ে তাঁর জীবন এক লিজেন্ডারী ইতিহাস। নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে আপসহীন থাকা এবং গণমানুষের অধিকারের জন্য শেষ পর্যন্ত লড়াই করে যাওয়াই তাঁকে সর্বজন স্বীকৃত ‘আপসহীন দেশনেত্রী’তে পরিণত করেছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস পড়বে, তখন বেগম খালেদা জিয়া‘র নাম উচ্চারিত হবে; সেইসব নেতাদের কাতারে যারা ক্ষমতার জন্য নয় বরং নীতির জন্য রাজনীতি করেছেন এবং জনগণের জন্য অবলীলায় উৎসর্গ করেছেন জীবন।▫️
0 Comments