আরাফাত রহমান কোকো : আত্মপ্রচারণা বিমুখ উদ্যোগী এক আলোকিত জীবনের ট্র্যাজিক সমাপ্তি
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন অনেক নাম আছে, যাদেরকে মানুষ শুধুমাত্র তাদের অর্জন, অবদান ও দেশপ্রেমের জন্য মনে রাখেনা। বরং তাদের অনেকে রাষ্ট্রযন্ত্র ও রাজনীতির অন্যায় প্রতিহিংসার শিকার হয়ে নিপীড়িত হয়েও তারা মানুষের স্মৃতিতে জায়গা করে নেন। তারা কেউ কেউ রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেছেন, কেউ ছিলেন প্রান্তিক পর্যায়ে, আবার কেউ রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ দূরে থেকেও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার নির্মম লক্ষ্যবস্তু পরিণত হয়েছেন।
দীর্ঘ এই তালিকায় এমন একজন ব্যক্তির নাম দ্ব্যর্থহীন ভাবে উল্লেখ করা যায়, যিনি ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন— অরাজনৈতিক এবং ক্রীড়ামোদী মানুষ; কিন্তু পারিবারিক পরিচয়ের কারণে রাষ্ট্রযন্ত্রের চরম প্রতিহিংসার শিকারে পরিণত হয়েছেন। তার জীবনের গল্প কেবল একজন মানুষের ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়— এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অসুস্থ মানসিকতার নগ্ন দলিল হিসেবে বিবেচিত।
যে নির্যাতিত মানুষটির কথা বলছি, তিনি হলেন— আরাফাত রহমান কোকো। তিনি জন্মেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবারে। তার পিতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ছিলেন— একাধারে বীরমুক্তিযোদ্ধা, সফল রাষ্ট্রনায়ক এবং জাতি ও রাষ্ট্র পুনর্গঠনের স্থপতি। মাতা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া— তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, যিনি গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় নির্ভীক ও আপোষহীন নেতৃত্ব দিয়েছেন। তবুও তার বেড়ে ওঠা ছিলো সহজ ও সাধারণ যা মোটেও বিলাসবহুল বা প্রিভিলেজড ছিল না।
‘জন্মসূত্রে তুমি হয়তো পরিচিত, কিন্তু সম্মান অর্জন করতে হলে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে।’
শৈশব থেকেই আরাফাত রহমান কোকোকে শেখানো হয়েছিল এই শিক্ষা। তাই তিনি অন্য বাচ্চাদের মতোই স্কুলের মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলেছেন, একসাথে টিফিন ভাগ করে খেয়েছেন। প্রাসাদের প্রাচুর্য তাড়িত জীবন নয় বরং সাদামাটা খাবার, সাধারণ পোশাক এবং নিয়ম-কানুনের কঠোর শাসনে বেড়ে ওঠা ছিল তার জীবনের বাস্তবতা।
আরাফাত রহমান কোকো’র বন্ধুরা তার স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে বলেন— ‘তিনি কখনও নিজের পরিচয় নিয়ে অহংকার করতেন না। তিনি ছিলেন লাজুক, বিনয়ী এবং পরোপকারী। পড়াশোনায় ছিলেন মনোযোগী, তবে ক্রীড়াঙ্গনের প্রতি ছিল তাট অদ্ভুত এক টান। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে কলেজ জীবন পর্যন্ত খেলাধুলা ছিল তার অন্যতম ভালোবাসার নাম।’
ক্রীড়াঙ্গনের প্রতি আরাফাত রহমান কোকো’র ভালোবাসা নিছক কোনো শখ ছিল না বরং এটি ছিল তার ভিশন ও মিশন। তিনি বিশ্বাস করতেন, খেলাধুলা কেবল শরীরচর্চার অংশ নয় বরং এটি একটি জাতির মনোবলের প্রকাশ ও ঐক্যের প্রতীক। তার নেতৃত্বে এবং পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্রীড়া অবকাঠামো উন্নত হয়েছে। ফুটবল ও ক্রিকেটে তরুণ প্রতিভাদের উত্থান ঘটেছে তার প্রত্যক্ষ সহায়তায়। খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণ, বিদেশ সফরের সুযোগ ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে তিনি ব্যক্তিগতভাবে এগিয়ে আসতেন।
তিনি কেবলমাত্র সভাপতির আসনে বসে ছবি তোলায় সীমাবদ্ধ ছিলেন না— তিনি সরাসরি মাঠে গিয়ে খেলোয়াড়দের সঙ্গে কথা বলতেন, তাদের সমস্যার সমাধান করতেন। অনেক সময় দেখা গেছে, খেলোয়াড়দের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম বা চিকিৎসার ব্যয় নিজের পকেট থেকে বহন করছেন তিনি।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করার জন্য আরাফাত রহমান কোকো বিদেশি দলের সঙ্গে প্রীতি ম্যাচের আয়োজন করেছেন, যুব খেলোয়াড়দের আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে পাঠিয়েছেন, এবং দেশের ভেতরে প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্টের সংখ্যা বাড়িয়েছেন। তার এই প্রচেষ্টা শুধু খেলাধুলার মানোন্নয়ন করেনি বরং তরুণ প্রজন্মের মাঝে সু-শৃঙ্খলা, নেতৃত্বগুণ এবং দলগত চেতনা গড়ে তুলেছে।
আরাফাত রহমান কোকো’র জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি শুরু হয় ২০০৭ সালে ১/১১-এর মধ্য দিয়ে। যখন কিনা মইন উদ্দিন আহমেদ ও ফখরউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা দখল করে। তাদের অন্যতম লক্ষ্য ছিল শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার ধ্বংস করা এবং বেগম খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিকভাবে অচল করা।
এই অবৈধ শাসনামলে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার আগুনে দগ্ধ হয়েছিল গোটা জাতি। বিএনপি’র বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান-সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের নির্বিচারে গ্রেফতার, নির্যাতন, মিথ্যা মামলায় জড়ানো— এসব ছিল প্রতিদিনের ঘটনা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই প্রতিহিংসা শুধু সক্রিয় রাজনীতিবিদদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি; অরাজনৈতিক ব্যক্তিরাও এর শিকার হয়েছেন।
তেমনি আরাফাত রহমান কোকো ছিলেন এর অন্যতম শিকার। তার একমাত্র ‘অপরাধ’ ছিল— তিনি শহীদ জিয়া ও বেগম খালেদা জিয়া’র সন্তান এবং জনাব তারেক রহমানের ছোট ভাই। কোনো প্রমাণ ছাড়াই, কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই তাকে গ্রেফতার করা হয়। দীর্ঘদিন কারাগারে বন্দি রেখে তার উপর চালানো হয় অকথ্য শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।
আরাফাত রহমান কোকোকে কারাগারের স্যাঁতস্যাঁতে ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে রাখা, চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা, পর্যাপ্ত খাবার না দেওয়ার মতো অত্যাচার পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছিল। যাতে তার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। একপর্যায়ে কারাগার থেকে মুক্তি দিলেও তাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়। তাছাড়া দেশের ভেতরে তার জন্য নিরাপদ কোনো পরিবেশ ছিল না বরং বিরাজ করছিল ভয়ংকর আতঙ্ক। চারপাশে গুপ্তচরদের নজরদারি, মিথ্যা মামলার হুমকি এবং পুনরায় গ্রেফতারের আশঙ্কা তাঁকে বাধ্য করে দেশত্যাগ করতে।
প্রবাসে গিয়েও আরাফাত রহমান কোকো শান্তি পাননি। শারীরিকভাবে ততোদিনে ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। দীর্ঘদিনের অবহেলা ও অমানবিক কারাবাসের ফলে তার শরীরে একাধিক জটিল রোগ বাসা বেঁধেছিল। চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন— তার অসুস্থতা শুধু শারীরিক নয়, এটি মানসিক ট্রমা ও দীর্ঘমেয়াদি স্ট্রেসের ফলাফল। প্রবাস জীবনে চিকিৎসা চলতে থাকলেও তার অবস্থার ধীরে ধীরে অবনতি হতে থাকে। হৃদরোগ, কিডনির সমস্যার পাশাপাশি তার ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হয়ে পড়ায় তিনি শারীরিকভাবে ভেঙে পড়েন। তবুও তিনি চেষ্টা করেছেন দেশের খবর রাখতে, মায়ের রাজনৈতিক লড়াইয়ে নীরবে সমর্থন দিতে এবং বন্ধু-শুভাকাঙ্ক্ষীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে।
অবশেষে একদিন খবর আসে— আরাফাত রহমান কোকো আর নেই। অল্প বয়সেই তার মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের জন্য নয় বরং গোটা জাতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি বলে বিবেচিত হয়। তার অকাল মৃত্যু ছিল একটি নিষ্ঠুর রাজনৈতিক প্রতিহিংসার প্রত্যক্ষ ফলাফল। তিনি হয়তো সরাসরি রাজনীতিতে ছিলেন না কিন্তু ক্রীড়াঙ্গনে তার অবদান, মানবিকতা এবং দেশের প্রতি ভালোবাসা তাকে মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী স্থান দিয়েছে। তার মৃত্যু আমাদের মনে করিয়ে দেয়— বাংলাদেশের তৎকালীন রাজনৈতিক প্রতিহিংসার চিত্র এমন যেখানে ব্যক্তির যোগ্যতা, অবদান কোনো গুরুত্ব পায়নি বরং ভিন্ন মতের এক নিরপরাধ ও উদ্যোগী মানুষের ট্র্যাজিক মৃত্যুই ছিলো রাষ্ট্রের প্রতিদান।
আরাফাত রহমান কোকো’র প্রতি রাষ্ট্র ও জাতির ঋণ আজো শোধ হয়নি। তার অবদান, ত্যাগ ও সংগ্রামের ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে। এটি শুধুমাত্র একটি ব্যক্তির স্মৃতি সংরক্ষণের বিষয় নয়— বরং একটি জাতির জন্য শিক্ষা যে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা কখনোই সভ্য সমাজের অংশ হতে পারে না। ইতিহাস একদিন এই অন্যায়ের বিচার করবে। কিন্তু তার আগে আমাদের দায়িত্ব— মরহুম আরাফাত রহমান কোকো’র অবদানকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পৌঁছে দেওয়া। খেলাধুলা, মানবিকতা এবং ন্যায়বিচারের প্রতি তার ভালোবাসা চিরকালের জন্য আমাদের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।
0 Comments