বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী ও জাতীয়তাবাদের পুনর্জাগরণ

বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের পুনর্জাগরণ

— ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. একেএম শামছুল ইসলাম, পিএসসি, জি (অব.)

‘‘বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তিত হয়েছে, তবে তার মূল আদর্শ বদলায়নি এবং সেটি হলো— বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ।’’

বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী কেবলমাত্র একটি সামরিক বাহিনী নয় বরং এটি একটি জাতির আত্মার প্রতিফলন এবং একটি আদর্শের রূপায়ণের বাস্তবায়নের অন্যতম পথিকৃৎ। সেই আদর্শ হলো— বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ।

বাংলাদেশের জন্ম কোনো সহজ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হয়নি। দীর্ঘকাল ধরে পাকিস্তানি শাসন এবং বাঙালি জাতির ওপর বঞ্চনার প্রতিক্রিয়ায় ১৯৭১ সালে মেজর জিয়া’র স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়। সেই যুদ্ধ শুধু একটি ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধ ছিল না; সেটি ছিল একটি নতুন জাতীয় চেতনার জন্ম।

স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক অবস্থা কেন্দ্র করে সশস্ত্রবাহিনীর মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করে একটি বিশেষ মহল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সশস্ত্র বাহিনীকে দুর্বল করা এবং তাদের বিভক্ত করা যাতে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়ে।

শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম সেনাবাহিনীকে কোনো রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য ব্যবহার করেননি; বরং তিনি এই বাহিনীকে একটি আদর্শিক কাঠামোর মধ্যে গড়ে তুলেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, একটি শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনীই একটি স্বাধীন জাতির রক্ষাকবচ। তিনি "বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ" নামক যে দর্শনের বিকাশ ঘটিয়েছিলেন, সেটি সশস্ত্র বাহিনীর জন্য একটি প্রেরণার উৎসে পরিণত হয়েছিল।

কিন্তু দুঃখজনকভাবে ফ্যাসিবাদী অপশক্তি এই বাহিনীকে নিজেদের ক্ষমতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে। তারা এই বাহিনীকে রাজনীতিকরণ করেছে, আদর্শহীন নেতৃত্বের মাধ্যমে বাহিনীর মনোবল নষ্ট করেছে এবং তাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে।

এরপরও বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী তার মূল বিশ্বাস ও আদর্শ থেকে সরে যায়নি। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ আমরা দেখতে পাই ২০২৪ সালের জুলাই-আগষ্ট গণঅভ্যুত্থান ও দেশব্যাপী প্রতিরোধের সময়। যখন গোটা জাতি আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল, তখন বাংলাদেশের সেনাবাহিনী জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান না নিয়ে নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছিল এবং কোনো গণহত্যা বা সহিংস দমন-পীড়নে অংশ নেয়নি। এটি ছিল একটি যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত।

এই ঘটনায় সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক। এটি প্রমাণ করেছে যে সেনাবাহিনী এখন আর কারো দাস নয়; এটি একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান, যার নিজস্ব আদর্শ এবং চেতনা আছে।

এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর বর্তমান ভূমিকার মূল্যায়ন করা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এই বাহিনী যদি তাদের আদর্শিক অবস্থান বজায় রাখতে পারে এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থাকে, তাহলে এটি আগামী দিনে জাতীয় পুনর্গঠনে একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারবে।

বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনী আজ কেবল একটি বাহিনী নয়, এটি একটি জাতির আত্মপরিচয়ের ধারক ও বাহক। এটি একটি দায়িত্ববান ও আদর্শিক বাহিনী হিসেবে জাতির কাছে নিজেদের প্রমাণ করেছে।

তবে এই অর্জন কেবল বাহিনীর নিজের নয়; এটি জাতির, এটি সেই চেতনাসমূহের যা মহান মুক্তিযুদ্ধে জন্ম নিয়েছিল, শহীদ জিয়াউর রহমানের হাতে পরিপুষ্ট হয়েছিল এবং আজ তারেক রহমানের নেতৃত্বে নতুনভাবে উদ্ভাসিত হচ্ছে।

১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বরের বিপ্লব থেকে শুরু করে ২৪-এর জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত সশস্ত্র বাহিনী সবসময়েই জনগণের আবেগ, আশা ও বিশ্বাসের প্রতীক হয়ে থেকেছে।

এই প্রেক্ষাপটে সশস্ত্রবাহিনীর জন্য তিনটি প্রধান স্তম্ভকে আরো সুদৃঢ় করা অপরিহার্য :

  1. বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের আদর্শিক শিক্ষা বাহিনীর অভ্যন্তরে প্রতিষ্ঠা করা।
  2. যোগ্যতা ও দেশপ্রেমের ভিত্তিতে নেতৃত্ব গঠন।
  3. জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক সুদৃঢ় করা।

বাংলাদেশের ইতিহাস প্রমাণ করেছে, যখনই জাতি সংকটে পড়েছে সশস্ত্রবাহিনীই তার নির্ভরযোগ্য আশ্রয়ে পরিণত হয়েছে। সুতরাং, এই বাহিনীর প্রতি আমাদের আস্থা, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা বজায় রাখা জাতি হিসেবে আমাদের দায়িত্ব।

সবশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তিত হয়েছে, তবে তার মূল আদর্শ বদলায়নি এবং সেটি হলো— বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ।

শহীদ জিয়াউর রহমান এই বাহিনীকে যেভাবে রচনা করেছিলেন, জনাব তারেক রহমান সেই ধারাকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন। আজ বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ পুনরায় এই বাহিনীর মেরুদণ্ড হয়ে দাঁড়াচ্ছে এবং এটি দেশের নিরাপত্তা, অগ্রগতি ও গৌরবের প্রতীক হয়ে উঠছে।

লেখক : ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. একেএম শামছুল ইসলাম, পিএসসি, জি (অব.)
সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।