লেখক: সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
বিশেষজ্ঞ, ভূ-রাজনীতি। জাতীয়তাবাদ বিষয়ক বিশ্লেষণে। চু-রাজনীতি, কৌশলগত নিরাপত্তা ও বিশ্লেষক

রাজনৈতিক সংকটের এই সময়ে, রাজধানী ঢাকার চকবাজারে বিএনপি কর্মী সোহাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ড কেবল একটি ব্যক্তিগত শোক নয়, বরং একটি বৃহৎ রাজনৈতিক সংকেত। এটি আমাদের সামনে এক গভীর প্রশ্ন দাঁড় করায়- এটা কি নিছক অপরাধ, নাকি বড় কোনো রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অংশ? প্রশ্ন জাগে, এই ঘটনায় লাভবান হচ্ছে কে? রাষ্ট্র, জনগণ, নাকি কোনো অদৃশ্য তৃতীয় পক্ষ? বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি তাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে বহুবার সহিংসতা, দমন-পীড়নের শিকার হয়েছে। কিন্তু তারপরও দলটি বরাবরই দায়িত্বশীলতা ও আত্মত্মসংযমের নজির স্থাপন করেছে। সোহাগ হত্যার পর বিএনপি সেই একই পথ অনুসরণ করেছে। অপরাধী যেই হোক না কেন, তার বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে আজীবন বহিষ্কার করে তারা উদাহরণ সৃষ্টি করেছে যে, দলের ছত্রছায়ায় কোনো অপরাধীর আশ্রয় নেই। একইসঙ্গে দলটি এই ঘটনার নিরপেক্ষ বিচার এবং
পরিবেশ তৈরি করা। তবে এটা শুধু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের
একাংশের রাজনৈতিক স্বার্থেই সীমাবদ্ধ নয়। এর পেছনে তৃতীয় পক্ষ বা অদৃশ্য অপশক্তির লাভবান হওয়ার স্পষ্ট আলামতও রয়েছে। প্রথমত, বিএনপি দীর্ঘ ১৭ বছরের দমন-পীড়ন সত্ত্বেও জনগণের মধ্যে জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ঐতিহাসিক গণজাগরণে তাদের সক্রিয় ও কৌশলী ভূমিকা জনসাধারণকে নতুন করে উদ্বুদ্ধ করেছে। সেই প্রেক্ষাপটে, বিএনপির মধ্যে যে তরুণ নেতৃত্ব, নতুন জনসম্পৃক্ততা এবং আদর্শিক সংহতি গড়ে উঠেছে, তা যে কোনো স্বৈরাচারী শাসনের জন্য হুমকি। তাই একটি পরিকল্পিত প্রচারণার মাধ্যমে বিএনপিকে সহিংসতা-প্রবণ, দলগত অপরাধে লিপ্ত এবং জনগণের বিশ্বাসযোগ্যতা হারানো একটি দল হিসেবে প্রমাণ করার চক্রান্ত অব্যাহত
রয়েছে। এই জায়গাতেই তৃতীয় পক্ষের লাভের জায়গা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বহুকাল ধরেই তৃতীয় পক্ষ, অন্তরালে থাকা সুবিধাভোগী শক্তিগুলো যেকোনো অস্থিতিশীলতা থেকে ফায়দা লুটেছে। কখনো এটি প্রশাসনের ভেতরকার একটি গোষ্ঠী, কখনো বহির্বিশ্বের কূটনৈতিক স্বার্থান্বেষী, আবার কখনো বা তথাকথিত বেসরকারি 'গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা 'সুশীল সমাজ' যারা আন্তর্জাতিক স্বার্থে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে প্রভাবিত করে। ভারা জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে জিম্মি করে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে।
যেমন, বিএনপি যখন তাদের অভ্যন্তরীণ শুদ্ধি অভিযান চালায়, অপরাধীর বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়, তখন সেই পদক্ষেপকে সাধুবাদ না জানিয়ে বরং এটিকে দলের ব্যর্থতা, 'বিভাজনের ইঙ্গিত' কিংবা 'নেতৃত্বহীনতার প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এই অপপ্রচার
সোহাগ হত্যাকাণ্ড ও রাজনীতির
উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং এর মাধ্যমে বিএনপির সাংগঠনিক নৈতিক শক্তিকে দুর্বল করার চেষ্টা করা হয়। গণমাধ্যমের কিছু অংশ এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ট্রল বাহিনীও তৎপর হয়ে উঠে যাতে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয় এবং বিএনপির প্রতি সহানুভূতির পরিবর্তে সন্দেহ তৈরি হয়।
এইসব অপচেষ্ট। একদিকে যেমন রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা ও বিচারব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, অন্যদিকে জনমনে একধরনের হতাশা ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করে। এটি কেবল বিএনপির বিরুদ্ধে নয়, পুরো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক প্রকার মনস্তাত্ত্বিক আগ্রাসন। এখানে আরেকটি ভয়ংকর প্রবণতা লক্ষ্য করা
যায়, যেটি হচ্ছে ছ্যাকাণ্ডের ভিডিও ধারণ ও
অনায়াসে তা ছড়িয়ে দেওয়া। সোহাগ হত্যাকাণ্ড
সংঘটিত হয়েছে দিনের আলোয়, পুলিশ ফাঁড়ি
থেকে মাত্র কিছু দূরে। তবু কেউ বাধা দেয়নি,
বরং ভিডিও করেছে। প্রশ্ন জাগে- এই ভিডিও
কি স্বতঃস্ফূর্ত। নাকি পূর্বপরিকল্পিত? এটি কি
জনমনে ভয় ঢোকানোর জন্য, নাকি বিএনপিকে অপমান করার একটি দৃষ্টান্তমূলক দৃশ্যায়ন? এই ভিডিওর অনিয়ন্ত্রিত প্রচারও প্রমাণ করে, কোনো একটি বিশেষ চক্র এর মাধ্যমে একটি 'মেসেজ' দিতে চায় যেখানে বিচার নেই, প্রতিরোধ নেই এবং প্রতিবাদ করলেও তাতে লাভনেই। এটি একটি রাষ্ট্রের পক্ষে ভয়ানক সংকেত। অন্যদিকে সরকারের নীরবতা ও পক্ষপাতমূলক প্রতিক্রিয়াও সন্দেহ বাড়িয়ে তোলে। বিএনপি যেই মুহূর্তে নৈতিক শক্তি নিয়ে অপরাধীর বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নেয়, সেই মুহূর্তেই রাষ্ট্রযন্ত্র তার বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু করে। আর এই সুযোগে তু তীয় পঞ্চ যারা দীর্ঘ সময় ধরে জনতার গণতান্ত্রিক চেতনায় আঘাত করে স্বৈরাচারী শাসনকে বৈধতা দেয় তারা আবারো সক্রিয় হয়ে উঠে। এই পুরো পরিস্থিতিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ মানুষ ও গণতন্ত্র। ভুক্তভোগীর পরিবার
দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে সরকার ও প্রশাসনের কাছে। এটাই রাজনৈতিক নৈতিকতা। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে এই অবস্থানকে গুরুত্ব না দিয়ে বরং বিএনপির বিরুদ্ধেই শুরু হয় নানা রকমের প্রোপাগান্ডা। এমন একটি হত্যাকাণ্ড, যেখানে ভিকটিম বিএনপির একজন সক্রিয় কর্মী এবং দল নিজেই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে- সেই ঘটনায় কীভাবে বিএনপিকেই দায়ী করে বিক্ষোভ মিছিল করা হয়? কীভাবে এই ঘটনায় সরকারের মিডিয়া ও প্রচারযন্ত্র এমনভাবে সক্রিয় হয়, যেন সোহাগের মৃত্যুর জন্য দায়ী বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব? এই প্রবণতা কেবল রাজনৈতিক দেউলিয়াপনার বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং গণতান্ত্রিক চেতনার বিরুদ্ধে একটি সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা। কারণ অপরাধের বিচার চাওয়ার পরিবর্তে যেভাবে দোষ চাপানো হচ্ছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে, মূল লক্ষ্য হচ্ছে বিএনপির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করা এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে একধরনের ভয়ের
৮ পৃষ্ঠা ২ কলাম ৩
ন্যায়বিচার পায় না, আর রাজনীতিতে যারা আদর্শ ও মূল্যবোধ নিয়ে কাজ করতে চায়, তারা নিরুৎসাহিত হয়। অপরদিকে যে অপশক্তি সংকট থেকে ফায়দা লুটে, তারা আবারো শক্তিশালী হয়ে উঠে।
বিএনপি এই অবস্থায় একটি রাজনৈতিক ও মানবিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তারা সোহাগকে 'দলীয় কর্মী হিসেবে নয়, বরং একজন নাগরিক' হিসেবে দেখেছে। তার পরিবারকে আইনি সহায়তা ও সার্বিক সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বলেছে, "অপরাধীর কোনো দল নেই, অপরাধই তার পরিচয়।" এই বার্তা কেবল রাজনৈতিক অবস্থান নয়, বরং গণতন্ত্রের নৈতিক ভিত্তির প্রতীক।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে এই মানবিক ও রাষ্ট্রিক দায়িত্ববোধের প্রতিও অপপ্রচার চালানো হয়েছে। বিএনপিকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে, যেন তারা একে নিজেদের দায় এড়াতে নেওয়া কৌশল মাত্র। এই বিভ্রান্তির রাজনীতি গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ করে, ন্যায়বিচারের ধারণাকে বিকৃত করে।
তবে একথা বলা যায় না যে, এ সকল ষড়যন্ত্রে বিএনপি দুর্বল হয়ে পড়বে। বরং এসব আঘাতই তাদের রূজনৈতিক চেতনা ও জনসম্পৃক্ততাকে আরও শাণিত করছে। বিগত ১৭ বছরের দীর্ঘ সংগ্রাম, আন্দোলন, জেল-জুলুম, শহীদ ও আত্মত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে যে শক্তি তৈরি হয়েছে, তা সামান্য প্রোপাগান্ডায় ক্ষয়ে যাওয়ার নয়। বরং এই সময়ের চালেঞ্জগুলো বিএনপিকে তারুণোর প্রতি দায়বদ্ধতা ও জাতির প্রতি দায়িত্ব আরও দৃঢ়ভাবে মনে করিয়ে দিচ্ছে।
0 Comments