মাইলস্টোনের শিক্ষার্থীদের রক্ত যেন বৃথা না যায়
২১ জুলাই ২০১৫, একটি দিন, যা চিরতরে বাংলাদেশ জাতির হৃদয়ে গভীর বেদনার এক রক্তাক্ত চিহ্ন হয়ে থাকবে। রাজধানী ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজে একটি মর্মান্তিক বিপর্যয় নেমে আসে; যখন বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি F-7 যুদ্ধবিমান নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সরাসরি স্কুল ভবনে বিধ্বস্ত হয়। এই দুর্ঘটনায় বহু শিক্ষার্থী ও শিক্ষক অকালে প্রাণ হারান, যাদের স্বপ্ন, সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ এক মুহূর্তে থমকে যায়। জাতি এই শোক কাটিয়ে উঠতে পারবে কিনা, তা ভবিষ্যতের হাতে। তবে এই ঘটনার পেছনে যে রাষ্ট্রের সীমাহীন ব্যর্থতা, রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি ও নীতিহীনতা দায়ী, তা আর কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই।
এই মুহূর্তে জাতি যদি না জাগে, যদি না প্রশ্ন তোলে, যদি না জবাবদিহি দাবি করে, তবে ২১ জুলাইয়ের মতো আরও অনেক দুর্ঘটনা সামনে অপেক্ষা করছে।
এই ঘটনার তাৎক্ষণিক শোক ছাড়াও, রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের কাছে এটি ছিল এক জাগরণের মুহূর্ত। F-7-এর মত্যে পুরনো, বহু দেশের বাতিল করা যুদ্ধবিমান দিয়ে আজও বাংলাদেশ তার আকাশ প্রতিরক্ষা পরিচালনা করছে, সেটি এক চরম উদ্বেগের বিষয়। এই যুদ্ধবিমানটির প্রযুক্তি গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের, যা আধুনিক বিমানবাহিনীর অনুশীলন, নিরাপত্তা এবং যুদ্ধ সক্ষমতার সঙ্গে একেবারেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। প্রশ্ন উঠেছে- কেন এই বিমান এখনও উড়ছে? কেন একটি জনবহুল এলাকায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপরে এ ধরনের অনুশীলন চলছিল? এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা এক গভীর কাঠামোগত ব্যর্থতা ও অব্যবস্থাপনার চিত্র দেখতে পাই।
এই ব্যর্থতা কোনো হঠাৎ ঘটনার ফল নয়। এটি বিগত দেড় দশক ধরে চলা একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ধ্বংসের ধারাবাহিকতার ফল। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার দেশের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে ফেলেছেন। বিশেষজ্ঞ মহল দীর্ঘদিন ধরেই আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছিল যে, প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে পরিকল্পিতভাবে দুর্বল করে দেওয়া হচ্ছে এবং এতে বিদেশি প্রভাব, বিশেষত এক প্রতিবেশী দেশের প্রেসক্রিপশন অনুসরণ করা হচ্ছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, ২১ জুলাইয়ের ঘটনা সেই আশঙ্কাকেই প্রমাণিত করল।
বাংলাদেশের প্রতিরক্ষানীতি কখনোই একটি সরকারের নিজস্ব সম্পত্তি নয়। এটি একটি জাতীয় কৌশলগত ভিত্তি, যার ওপর দাঁড়িয়ে একটি রাষ্ট্র তার সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা রক্ষা করে। কিন্তু বিগত সরকারের আমলে দেখা গেছে যে, প্রতিরক্ষা বাজেট শুধু লুটপাট ও কমিশন বাণিজ্যের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিমানবাহিনী আধুনিকীকরণ, যুদ্ধবিমান পরিবর্তন, রাডার ব্যবস্থা সম্প্রসারণ, বিমানচালক প্রশিক্ষণ উন্নয়ন- এসব মৌলিক বিষয়েও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বরং পুরনো, অনিরাপদ ও প্রাণঘাতী প্ল্যাটফর্মগুলোকে পুনরায় রঙ করে, মেরামত করে কাজে লাগানো হয়েছে- যা একটি জাতির জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পরিস্থিতি কেবল দুর্নীতি ও অদক্ষতার ফল নয়ঃ এটি একটি সুপরিকল্পিত জাতীয় নিরাপত্তা নস্যাৎ করার চেষ্টা। প্রতিরক্ষা খাতকে দুর্বল রেখে একটি নিরপেক্ষ, নীরব এবং নির্ভরশীল রাষ্ট্রে পরিণত করার এক আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের বাস্তবায়ন হয়েছে। আর এই ষড়যন্ত্রের সহযোগী হয়েছেন কিছু উচ্চপদস্থ আমলা, রাজনৈতিক উপদেষ্টা এবং সাবেক সামরিক কর্মকর্তারা, যারা ক্ষমতার লোভে এবং বিদেশি প্রশ্রয়ে দেশের প্রতিরক্ষা সক্ষমতাকে বিকিয়ে দিয়েছেন।
তাদের লক্ষ্য ছিল পরিষ্কার- একটি প্রযুক্তিগতভাবে দুর্বল, কৌশলগতভাবে বিভ্রান্ত এবং মানসিকভাবে পরাজিত প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করা, যারা শুধু সরকার রক্ষায় ব্যস্ত থাকবে, কিন্তু দেশের আকাশসীমা রক্ষার যোগ্যতা হারাবে। ২১ জুলাইয়ের দুর্ঘটনা তারই জ্যান্ত প্রমাণ। কেবল একটি যুদ্ধবিমান নয়, পুরো দেশের প্রতিরক্ষা কৌশল ভেঙে পড়েছে এই এক ঘটনায়। কারণ, এটি কেবল বিমানবাহিনীর ব্যর্থতা নয়, এটি রাষ্ট্রের ব্যর্থতা।
আরও গভীর দৃষ্টিতে দেখা যায়, এই দুর্ঘটনা কেবল সামরিক সংকট নয়, এটি একটি সামাজিক সংকটও। বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় তরুণ প্রজন্মের একাংশ- যারা এ দেশের আগামী দিনের নেতা, শিক্ষক, ডাক্তার, বিজ্ঞানী হতে পারতো- তাদের জীবন কেড়ে নিয়েছে এই অব্যবস্থাপনা। মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজ একটি প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে স্বপ্ন, শৈশব এবং শিক্ষা একসঙ্গে পুড়ে ছাই হয়েছে। এই ঘটনা একটি প্রজন্মের আত্মবিশ্বাসে আঘাত করেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেখানে জাতি নির্মাণের ভিত্তি গড়ে ওঠে, সেখানে যদি আকাশ থেকে মৃত্যু নেমে আসে, তাহলে জাতি আর কোথায় নিরাপদ? এই প্রেক্ষাপটে একটি প্রশ্ন এখন স্পষ্ট: আমরা কি এই ধ্বংসপ্রবণ নীতির ধারাবাহিকতা মেনে নেব, নাকি এর বিরুদ্ধে দাঁড়াব? দেশের স্বাধীনতা শুধু কাগজে নয়, বাস্তবেও রক্ষা করতে হয় এবং সেটা সম্ভব হয় একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষাকাঠামোর মাধ্যমে, যেখানে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী সমন্বিতভাবে কাজ করে। এর জন্য প্রয়োজন বাস্তবভিত্তিক কৌশল, প্রজাসম্পন্ন নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা। এসবের একটি স্তন্ত্রেও বিগত সরকার দাঁড়াতে পারেনি বরং প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা জাতির সঙ্গে প্রতারণা করেছে।
আকাশ প্রতিরক্ষা উন্নয়ন একটি স্বল্পমেয়াদি প্রকল্প নয়। এটি একটি বহুমাত্রিক, দীর্ঘমেয়াদি এবং টেকসই প্রক্রিয়া। আধুনিক যুদ্ধবিমান ক্রয়, স্যাটেলাইটভিত্তিক নজরদারি, UAV (ড্রোন) প্রযুক্তি, ব্যালিস্টিক মিসাইল ডিফেন্স ও মাল্টিলেয়ার রাডার সিস্টেম নির্মাণ- এই সবকিছু মিলিয়ে একটি কার্যকর আকাশ প্রতিরক্ষা গড়ে ওঠে। কিন্তু এসব উন্নয়ন যদি শুধু বিদেশি লবিস্টদের স্বার্থে থেমে থাকে, তবে জাতির ভবিষ্যৎ আর সুরক্ষিত থাকবে না।
এই পরিস্থিতিতে আমাদের সামনে কয়েকটি জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। প্রথমত, বিমানবাহিনীর সব পুরনো যুদ্ধবিমান অবিলম্বে কার্যক্রম থেকে প্রত্যাহার করতে হবে এবং নিরাপদ স্থানে সংরক্ষণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, আকাশ প্রতিরক্ষার আধুনিকায়নে একটি জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে, যেখানে সামরিক বিশেষজ্ঞ, কৌশলবিদ, প্রকৌশলী ও নীতিনির্ধারকরা একসঙ্গে একটি রোডম্যাপ তৈরি করবেন। তৃতীয়ত, বাজেট বরাদ্দের ব্যবহার এবং বাস্তবায়ন তদারকির জন্য স্বাধীন নিরীক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে। দুর্নীতি ও অপচয়ের বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। চতুর্থত, প্রতিরক্ষা খাতে একটি প্রযুক্তি হস্তান্তর নীতি গ্রহণ করতে হবে, যাতে বাংলাদেশে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তৈরি ও মেরামতের দক্ষতা গড়ে তোলা যায় এবং বিদেশনির্ভরতা হ্রাস পায়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বুঝতে হবে যে, একটি দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা কোনো দলের স্বার্থে নয়- এটি একটি জাতির অস্তিত্বের প্রশ্ন। যারা আজ ক্ষমতায় না থেকেও প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা ও দেশপ্রেম নিয়ে জাতির জন্য একটি বিকল্প পথ তৈরির চেষ্টা করছে, তাদের নেতৃত্বেই একটি নতুন প্রতিরক্ষা চেতনার বিকাশ ঘটতে পারে। এখনই সেই সময়- একটি জনভিত্তিক, সমন্বিত এবং প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিরক্ষা কাঠামো গড়ে তোলার।
আমার মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে- আমরা কি সত্যিই মানুষ হয়েছি, নাকি আমরা কেবল এক নিষ্ক্রিয়, প্রতিক্রিয়াহীন জনতা, যারা চোখের সামনে শিশুদের মৃত্যু দেখে কেবল কাঁদে কিন্তু প্রতিরোধ গড়ে তোলে না?
এই মুহূর্তে জাতি যদি না জাগে, যদি না প্রশ্ন তোলে, যদি না জবাবদিহি দাবি করে, তবে ২১ জুলাইয়ের মতো আরও অনেক দুর্ঘটনা সামনে অপেক্ষা করছে। আর সেদিন আমরা কেবল কাঁদব, কিন্তু কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারব না। তাই এখনই সময়- একটি শোককে শক্তিতে রূপান্তরের, একটি বেদনার মুহূর্তকে পরিবর্তনের দাবিতে রূপ দেওয়ার।
মাইলস্টোনের শিক্ষার্থীদের রক্ত যেন বৃথা না যায়। তাদের আত্মত্যাগ যেন রাষ্ট্রকে জাগিয়ে তোলে। একটি নিরাপদ বাংলাদেশ, একটি সক্ষম বিমানবাহিনী, একটি আধুনিক প্রতিরক্ষা কাঠামো- এটিই হবে তাদের প্রতি আমাদের প্রকৃত শ্রদ্ধা।
0 Comments